বাংলা সালতানাত : দিল্লির পূর্ণ আনুগত্যকাল
মালিক তমর খান কিনার (১২৪৫-১২৪৭)
মালিক তমর খান কিনারও ছিলেন দিল্লীর অননুমোদিত শাসনকর্তা। তখনকার দিল্লীর সুলতান আলা-উদ-দীন মাসুদ শাহ এতই দুর্বল প্রকৃতির লোক ছিলেন যে, তিনি মালিক তমর খান কিনারকে এজন্য কোন শাস্তিও দিতে সাহসী হন নি, অথবা তুগরল তুগান খার প্রতি এই অবিচারের কোন প্রতিবিধানও করতে পারেন নি।১২৪৬ সালে সুলতান ইলতুমিসের কনিষ্ঠা পুত্র নাসিরুদ্দিন মাহামুদ দিল্লীর সুলতান
হওয়ার পর তুগ্রুল তুগান খাকে অযোধ্যার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে তার প্রতি কিছুটা সুবিচার করেন। তুগান খা অযোধ্যার শাসনভার গ্রহণ করার কিছুদিন পর ১২৪৭ সালে পরলোক গমন করেন। ভাগ্যের পরিহাস বলতে হবে, লাখনৌতিতে প্রায় ২বছর শাসনকর্তা হিসাবে শাসনকার্য চালিয়ে মালিক তমর খান কিরান ও একই দিনে মৃত্যুমুখে পতিত হন। ওদিকে পরিস্তিতির সুযোগে রাঢ অঞ্চল উরিষ্যারাজ নরসিংহদেবের অধিকারেই থেকে যায়।
মালিক জালাল-উদ-দীন মাসুদ জানী (১২৪৭-১২৫১ সাল)
তমার খান কিরানের মৃত্যর পর মালিক আলা-উদ-দীন জানীর পুএ মালিক জালাল উদ-দীন মাসুদ জানীর ৪ বছর কাল শাসনের পর লাখনৌতির শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।মাসুদ জানীর ৪ বছর কাল শাসনের পর লাখনৌতির শাসনকর্তা নিযুক্ত হন মালিক ইখতিয়ার উদ দীন ইউজবুক।
মালিক ইখতিয়ার উদ-দীন ইউজবক (১২৫১- ১২৫৭ সাল)
দিল্লীর সুলতানের প্রতি বিদ্রোহ ভাবাপন্ন থাকলেও মালিক ইউজবক দিল্লীর প্রধান উজির গিয়াস উদ-দীন বলবনের স্নেহভাজন ছিলেন । তিনি ছিলেন সাহসী কর্মঠ সমরনিপুন ও সুশাসক ।লাখনৌতির মুসলিম রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হন এবং তাতে বেশ সাফল্য ও অর্জন করেন। তিনি উরিষ্যা রাজের হাত থেকে রাঢ অঞ্চল পুর্নদখল করেন ।এবারে দিল্লী সুলতানের বিরুদ্ধে আবার বিদ্রোহ করে সুলতান মুগিস উদ দীন উপাধি গ্রহন করে স্বধীনতা ঘোষনা করেন ।তারপর ১২৫৫ সালে আরম্ভ হয় তার কামরূপা অভিযান এবং এই অভিযানেই তিনি বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়ে ১২৫৭ সালে মৃত্যু মুখে পতিত হন।
ইযয-উদ-দীন বলবন-ই-ইউজবুকী (১২৫৭-১২৫৯ সাল)
সুলতান মুগিস - উদ- দীন ইজবুকের মৃত্যুর পরে লাখনৌতি আবার পুরোপুরি দিল্লীর আধীনস্ত একটি প্রদেশে পরিনত হয়।লাখনৌতির শাসনকর্তা নিযুক্ত হন ইযয উদ-দীন বলবান-ই-ইউজবুকী। তিনিও ছিলেন সুলতান ইলতুমিশের ক্রিতদাস এবং মালিক জালাল উদ-দীন মাসুদ জানীর জামাতা । দিল্লীতে ইমাদ উদ-দীন যখন প্রধান উজির তখন তিনি ছিলেন রাজদরবারের আমির । কিন্তু গিয়াস উদ-দীন বলবান পুনরায় প্রধান উজির হওয়ার পর তিনি দিল্লী থেকে পালিয়ে লাখনৌতি চলে আসেন এবং লাখনৌতির বিদ্রোহ শাসনকর্তা সুলতান মুগীস-উদ-দীনের মৃত্যু হলে তিনি দিল্লীর অনুমতি না নিয়েই লাখনৌতির শাসনকর্তা হয়ে বসেন । পরে অবশ্যে তিনি দিল্লির অনুগত্য স্বীকার করেন এবং প্রকৃত প্রস্তাবে স্বাধীনভাবে লাখনৌতি রাজ্য শাসন করলেও দিল্লির সুলতানের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। অতঃপর ১২৫৯ সালে মালিক বলবান ইউজবুকি পূর্ব বাংলা আক্রমণ করেন এবং তা করতে গিয়ে লাখনৌতির পঞ্চম শাসনকর্তা গিয়াস উদ্দিন ইওজ খিলজির মতো রাজধানী রক্ষার সুব্যাবস্থা না করেই পূর্ব বাংলা অভিযানে অগ্রসর হন। ফলে লাখনৌতির দুর্বল রক্ষা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে কারা প্রদেশের শাসনকর্তা মালিক তাজউদ্দীন আরসালান খাঁ লাখনৌতির গদী দখল করেন। লাখনৌতির অধিবাসিরা তাকে বাধা দিয়ে ও শেষ রক্ষা করতে ব্যার্থ হন। খবর পেয়ে বলবান ইওজবুকি লাখনৌতির পথে ছুটে আসেন। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিহত হন।
মালিক তাজউদ্দীন আরসালান খাঁ (১২৫৯-১২৬৫ সাল )
মালিক তাজউদ্দীন আরসালান খাঁ ছিলেন খিবার আমিরের পুত্র। প্রথম বয়সে যুদ্ধে বন্ধি হয়ে ক্রীতদাসস্বরূপে বিক্রিত হন এবং কয়েকবার বিক্রিত হয়ে হয়ে অবশেষে সুলতান ইলতুমিশের হাতে এসে পড়েন। তিনি ও জালালুদ্দিন মাসুদ জানির মতো কয়েকবার দিল্লি সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। কিন্তু গিয়াস উদ্দিন বলবানের সুপারিশে তাকে ক্ষমা করা হয় এবং কারা প্রদেশের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়। কারা প্রদেশের শাসনভার পেয়েও তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। তার লোলুপ দৃষ্টি লাখনৌতির উপর। অবশেষে সে আশা ও পূর্ণ হয়। ১২৬৫ সালে তিনি লাখনৌতির শাসক রূপে পরলোক গমন করেন।
তাতার খান (১২৬৫-১২৬৮ সালের প্রথম দিক )
মালিক তাজউদ্দীন আরসালান খাঁর মৃত্যুর পর তাতার খান বিহার ও লাখনৌতির শাসন ক্ষমতা লাভ করেন। ১২৬৬ সালে দিল্লির সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদের মৃত্যু হলে দিল্লিতে আরম্ভ হয় বলবনি সুলতানদের শাসন। উলুঘ খান বলবান সুলতান গিয়াসউদ্দিন উপাধি ধারণ করে দিল্লি মসনদে আহরণ করেন। তাতার খান উপলদ্ধি করেন যে দিল্লিতে ক্ষমতার এই হাত বদলের ফলে সুলতান ইলতুমিশের মৃত্যুর পর ৩০ বছর ধরে দিল্লিতে যে দুর্বল শাসন এবং তজ্জনিত অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চলে আসছিল তার অবসান হলো। কারণ বলবান ছিলেন সাহস , বীরত্ব , প্রশাসনিক দক্ষতা ও কূটনীতি জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত। তাই কাল বিলম্ব না করে তাতার খান ৩৬ টি হাতি সহ বহুমূল্যের উপহার পাঠালেন দিল্লিতে। সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবান ও সেই উপহার সস্মানে গ্রহণ করে তাতার খানের দূতকে উপহার সহ বিধায় দিলেন। লাখনৌতি আবার চলে গেল দিল্লির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তাতার খান বেশি দিন শাসন করতে পারেন নি। অল্পদিনের মধ্যৈ তিনি মারা যান।
শের খান (১২৬৮-১২৭২ সাল )
তাতার খানের মৃত্যুর পর তারই বংশের শের খান লাখনৌতির শাসন ভার গ্রহণ করেন এবং সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের নামে মুদ্রা প্রচলন করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে ১২৬৬ সালে সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পরপরই লখনৌতি থেকে শেষ হয়ে যায় তুর্কি শাসন। দিল্লিতে সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবনের মসনদ লাভের পর লাখনৌতিতে ও আরম্ভ হয় ক্ষমতার পট পরিবর্তন।
Post a Comment